করোনা মহামারির ভয়াবহ রূপ দেশের চিকিৎসা সেবাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগী উপচে পড়ছে। আইসিইউ ও সাধারণ শয্যা সংকট তীব্র। অধিকাংশ স্থানে শয্যার চেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসাধীন।
এ অবস্থায় একটি শয্যার জন্য রাজধানী ও অন্যান্য বড় শহরে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালে ছুটছেন। এরপরও দেশে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে ফিল্ড হাসপাতাল চালু হয়নি। অথচ ৯ জুলাই বিএসএমএমইউ কনভেনশন সেন্টারসহ রাজধানীর পাঁচশটি স্থানে করোনা ফিল্ড হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বিভাগীয় ও জেলা পর্যয়ে মানসম্মত বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কোভিড চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু এরপর প্রায় এক মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। কোথাও এ ধরনের হাসপাতাল চালু হয়নি। ঢাকার বাইরের জন্য এখনও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া জানান, ৯ জুলাই এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- এখন পর্যন্ত একটিও চালু হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ড হাসপাতাল চালুর জন্য প্রথম দফায় দেওয়া সময় পার হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দ্বিতীয় দফা সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্য কোনোটির বিষয়ে কারও কাছে তথ্য নেই।
দেশের হাসপাতালগুলোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় ৩১ জুলাই থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এক হাজার শয্যার ফিল্ড হাসপাতাল চালু হওয়ার কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেনশন সেন্টারে এ হাসপাতাল স্থাপনে প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী স্থান পরিদর্শন করেও এ কথা জানিয়েছিলেন। তবে যথাসময়ে চালু হয়নি সেটি। এমনকি এটি চালু হতে কতদিন সময় লাগবে সেটিও এক প্রকার অনিশ্চত। তবে বৃহস্পতিবার স্বল্প পরিসরে এ ফিল্ড হাসপাতাল চালু হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে মঙ্গলবার করোনাসংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন শনিবার থেকে এটা চালু হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, আমরা আশা করছি বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউর ফিল্ড হাসপাতাল চালু হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিডসংক্রান্ত সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যার তুলনায় বেশি কোভিড রোগী চিকিৎসাধীন আছেন।
রাজধানীর ১২টি বেসরকারি পর্যায়ের হাসপাতালে কোনো শয্যা ফাঁকা নেই, একটিতে অতিরিক্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া চট্টগ্রামে দুটি, কুমিল্লায় একটি, ফেনীতে একটি, সিলেট-বরিশাল-পটুয়াখালী-বরগুনায় একটি করে হাসপাতালে শয্যাতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছেন। এছাড়া অনেক জেলায় কোভিড হাসপাতালে কোনো শস্যা ফাঁকা নেই। অধিকাংশ স্থানে অতিরিক্ত রোগী চিকিৎসাধীন।
জানা গেছে, রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে শয্যা ১৬৯টি অতিরিক্ত রোগী আছেন ৪ জন; কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শয্যা ২৭৫টি, অতিরিক্ত রোগী ৮২ জন; ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড শয্যা ৭০৫টি, অতিরিক্ত চিকিৎসাধী ৪৬ জন; মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ২৮৭টি, অতিরিক্ত ভর্তি ২ জন; বেসরকারি ল্যাব এইড হাসপাতালে শয্যা ৭২টি, অতিরিক্ত ভর্তি ৪ জন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ৩০০, অতিরিক্ত রোগী আছেন ৭ জন; বেসরকারি আল মানাহিল নার্চার জেনারেল হাসপাতালে শয্যা ৪৩টি, অতিরিক্ত আছেন ৫ জন, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড শয্যা ১০০টি অতিরিক্ত ভর্তি আছেন ৬২ জন; মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে শয্যা ৫০টি অতিরিক্ত ভর্তি আছেন ৬ জন; ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড শয্যা ২১০টি, অতিরিক্ত ভর্তি ২২ জন; চাঁদপুর ১৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে শয্যা ২৭৮টি, অতিরিক্ত ভর্তি আছেন ১৫ জন; বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ২৭৮টি, ভর্তি আছেন অতিরিক্ত ২৭ জন; পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা ৮০টি, ভর্তি আছেন অতিরিক্ত ২৮ জন; বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে শয্যা ৫০টি, অতিরিক্ত ভর্তি ৩৬ জন; সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতালে ৮৪টি অতিরিক্ত ভর্তি ৬ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় থেকে এখনো জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ের বেসরকারি হাসপাতালগুলোক কোভিড চিকিৎসার আওতায় আনতে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রাম বিভাগের একজন সিভিল সার্জন এবং রাজশাহী বিভাগের একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তারা লিখিত বা মৌখিক ভাবে এ ধরনের কোনো আদেশ বা নির্দেশনা পাননি। তবে তাদের জেলায় ও উপজেলায় করোনা রোগীর তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল।
জানা গেছে, রাজধানীতে ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করতে বিএসএমএমইউ ভিসিকে আহ্বায়ক এবং পরিচালককে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। জুলাইয়ের ১৪ তারিখ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ প্রশাসন-১ অধিশাখা থেকে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করে। কমিটির অন্য সদস্যের মধ্যে রয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রধান প্রকৌশলী স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, যুগ্মসচিব (পরিকল্পনা) স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, যুগ্মসচিব (সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা) স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং প্রকল্প পরিচালক কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্প।
কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়, করোনা ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, সার্বিক সহযোগিতা প্রদান, বাস্তবায়ন কার্যক্রম নিয়মিত পরিবীক্ষণ, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা পরিলক্ষিত হলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ, সময়ে সময়ে যে কোনো অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুতসংক্রান্ত তথ্য প্রতি সপ্তাহে প্রতিবেদন আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো।
২৫ জুলাই দুপুরে নির্মাণাধীন ফিল্ড হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, আগামী ৭ দিনের মধ্যে এর কার্যক্রম চালু করতে পারবে। ভিসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি, আশা করছি শনিবার (৩১ জুলাই) থেকে আমরা রোগী ভর্তি করতে পারব। তিনি বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। যেভাবে রোগী বাড়ছে তাতে হাসপাতালে শয্যা সংকট দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ শয্যা রোগীতে পূর্ণ। বিএসএমএমইউর ফিল্ড হাসপাতালটিতে ২০০ আইসিইউ, এইচডিইউসহ এক হাজার শয্যা থাকছে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বিএসএমএমইউর অনুকূলে ২৯ জুলাই তারিখে ১৬ কোটি ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এরমধ্যে চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে ৯ কোটি টাকা, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনায় ৪ কোটি টাকা, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কিনতে ১২ লাখ টাকা, সঙ্গনিরোধ ব্যয় বাবদ ৩ কোটি টাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যয় বাবদ ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা, রোগীর পথ্য বাবদ ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক বাবদ ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এর প্রেক্ষিতে ১ আগস্ট ফিল্ড হাসপাতাল দ্রুত চালু করার জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে কিনতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল হান্নান। সেখানে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব কনভেনশন সেন্টারে এক হাজার শয্যার কোভিড ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রথম পর্যায়ে ২০০ শয্যা নিয়ে কাজ শুরু সিদ্ধান্ত হয়েছে। দ্রুত ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে ডিপিএম পদ্ধতিতে কেনাকাটা ছাড়া বিকল্প নেই। তবে এখনো ডিপিএম করার অনুমোদন পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে হাসপাতাল চালু করতে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হতে পারে।
বিএসএমএমইউর ফিল্ড হাসপাতালের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পরিচালক ডা. নাজমুল করিম যুগান্তরকে বলেন, আপাতত এক হাজার শয্যার ফিল্ড হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে শিগগিরিই ২০০ শয্যার হাসপাতাল চালু করা হবে। যেখানে ২০ শয্যার আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) ও ২০ শয্যার এইচডিইউ (হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট থাকবে) থাকবে। এছাড়া প্রতিটি শয্যায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন পরিসঞ্চালন সংযোগ থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেশন সেন্টারের প্রাথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় এসব শয্যা স্থাপনের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি এ ২০০ শয্যা চালানোর মতো চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য কর্মী সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বৃহস্পতিবার ফিল্ড হাসপাতাল চালু হবে ইনশাআল্লাহ।
Array