ব্রিগেডিয়ার, গবেষক, ডিপ্লোমেট, দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি ইত্যাদি পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার ঈশিতা মোটেই পাপিয়া বা পরীমণি শ্রেণির নন। হেলেনা জাহাঙ্গীর গোত্রেরও নন। এমবিবিএস পাস তিনি। কিন্তু, ডাক্তারি পেশার চেয়ে নিজেকে উপযুক্ত করেছেন নানান বাজে কাজে হেলে পড়ায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, বিশিষ্ট আলোচক ইত্যাদি পরিচয়ে টক শোও করেছেন তিনি। র‌্যাব ধরার আগ পর্যন্ত কেউ জানতেন না, চিনতেন না এই প্রতারককে?

করোনার কিট ও চিকিৎসা জালিয়াতির ঘটনায় এর আগে শাহেদ মৌসুমে ধরা পড়েছিলেন আরেক ডাক্তার সাবরিনা। তিনিও ডাক্তারির চেয়ে বিজি থেকেছেন হেলে পড়ার বাণিজ্যে। ক’দিন ধরে এই গোত্রের কিছু নারী ধরার ধুম পড়ার অবস্থা। নাটকীয় ধরপাকড়ের সর্বশেষ সিরিয়ালে মডেল পিয়াসা ও মৌ । ডিবির জয়েন্ট কমিশনার হারুন অর রশীদের ভাষায়, এরা রাতের রানী। রাতের রানীরা গত রাত থেকেই হেলাদোলা করছে? এতোদিন পরহেজগার কেউ ছিল তারা? এতোদিন তা কেউ জানতো না?

হেলে বা না হেলে তৈরি করা এই নারীরা স্রেফ প্রমোদ তরী। ভ্রমণ শেষতো ঘাটে ডুবিয়ে দেয়া। এর আগ পর্যন্ত শিক্ষিকা, নায়িকা, গায়িকা এমন কি ডাক্তার, ব্যবসায়ীও। যে কারণে পিস্তল ওয়ালি শিক্ষিকাকে পুলিশ এখনো ধরে না। পিস্তলটাও জব্দ করে না। আবার ঘটনাচক্রে ধরা পড়ে গেলে সঙ্গে হরিণের চামড়া, মদসহ কতোকিছুই উদ্ধার ও জব্দ হয়।

পরীমণি কাণ্ডের পর চিত্রনায়িকা একা। এর আগে ক্ষেত্র ও প্রেক্ষাপটের ভিন্নতায় হেলেনা জাহাঙ্গীর সিরিয়ালে এসেছেন ভিকারুননিসার পিস্তলওয়ালি প্রিন্সিপাল কামরুন নাহার মুকুল। এর ফাঁকে ক’দিন চলেছে বিদিশাকে নিয়ে। এরপরের সিরিয়ালে চিত্রনায়িকা একা, ঈশিতা, মৌ, পিয়াসা। ঘটনা এবং কেস কাছাকাছি। অরুচিকর গালাগালে কমবেশি পারঙ্গম প্রিন্সিপাল মুকুলসহ সবাই। নানান জনের সঙ্গে হটলাইন সবারই। ক্যাডারের ভয় দেখায়, অস্ত্রের হুমকি দেয়। কারও বাসায় দেয়ালে ঝুলে হরিণ বা অন্য কোনো বন্যপ্রাণীর চামড়া। অভিযানে মেলে নানা কিসিমের মাদক। মদ-ইয়াবা একেবারে কমন। অস্ত্রও মেলে। সম্প্রতি যোগ হয়েছে ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহারের মাধ্যমে করে প্রতারণার কিচ্ছা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ ঘটা করে এদের ধরার খবরটি দিতে প্রেস কনফারেন্স ডাকে। গণমাধ্যম সেগুলো লুপে নেয়। বেশ রসিয়ে প্রকাশ করে। যেন এমন খবর এবারই প্রথম। এর চেয়ে বড় খবর বা সমস্যা আর নেই। এছাড়া নারীরাই যতো দুষ্টের গোড়া-এমন একটা ভাব প্রকাশের প্রবণতা স্পষ্ট। এই রমনীকূলের পাকড়াওয়ে সম্রাট, শামীম, খালেদ, শাহেদ, পাপুল, দর্জি মুনীররা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। লকডাউনে মৌসুমী বেকারত্বের দীর্ঘ অবসর সময়ে পরীমণি, মুকুল,হেলেনা, ঈশিতা, পিয়াসাদের ধরপাকড়ের স্যুটিং। আনলিমিটেড সার্কাসের মতো বিনোদন দিচ্ছে। সব সঙ্কট ভুলে ধরা খাওয়া সুন্দরীদের নিয়ে গালগল্প বেশ জমেছে।

পরীমণি, একা, সাবরিনা, পাপিয়া, মুকুল, হেলেনাদের জন্ম দেয়া রথিজনরা কিন্তু অধরাই থেকেই যান। হেলেনারা ধরা পড়ে গেলে নিজেরা আড়ালে চলে যান। কখনো কখনো ভাগে গন্ডগোল হলে, বেশি বেড়ে গেলে ধরিয়েও দেন। হেলেনা জাহাঙ্গীরের মতো ‘ আমার মন্ত্রী-ফন্ত্রি গোনার টাইম নাই, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কাউকে কেয়ার করি না’- এমন কথা বেশি সহ্য করাও কষ্টের গডফাদারদের। তখন ছুঁড়ে ফেলা ছাড়া আর গতি থাকে না। আড়ালে থেকে তারা তখন অন্যদিকে হেলেন। নতুন আইটেম কালেকশন করেন। ব্যবসার হাতিয়ারের পাশাপাশি মোজমাস্তির পার্টনার করেন। চলে আসছে এভাবেই। কখনো কখনো ঝড় ঝাপটা ছোটখাটোগুলোর ওপর দিয়েই যায়।

রাগববোয়ালরা টরেটক্কা খেলে। মজা দেখে। তারা পুরুষ না নারী সেটা মুখ্য হওয়া উচিৎ নয়।

নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ নিয়ে কিছু নারী মাদক থেকে শুরু করে হেন কুকাজ নেই যা না করছে। এদের কারণে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ কথাটির সর্বনাশ হচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন এরশাদ বেঁচে থাকলে হয়তো লজ্জা পেতেন। নিজেকে শিশু মনে করতেন। তার আমল থেকে এদেশে বাছাই করা সুন্দরীদের রাজনীতিতে এবং সংসদে বিশেষ অলঙ্কার করার চর্চা। যুক্তিটা ছিল নারীর ক্ষমতায়ন। কিছু উচ্চশিক্ষিত নারীকে সামনে আনা হলেও উল্টাকর্মে পারঙ্গম অনেককেও আনা হয়েছে। দলের বড়বড় পদ পদবী এরা হাতিয়েছেন অনায়াসে। গত বছর কয়েকে সেটা আর মাত্রার মধ্যে নেই। নায়িকা-গায়িকা পরিচয়ের বাইরেও এই গোত্রের কিছু নারী অপ্রতিরোধ্য গতিতে আগুয়ান। মাঠের রাজনীতিতে পোড় খাওয়ারা এতে বিরক্ত হলেও করার কিছু নেই। ভাগের গোলমাল, অতি বেড়ে যাওয়াসহ ঘটনাচক্রে ধরা পড়ে যাওয়ারা হেলেনা-পাপিয়াদের বিশাল আইসবার্গের উপরের সামান্য অংশ মাত্র। এই সোসাইটির বাকিরা মাঠ দাবড়াচ্ছে। খুব প্রতিকুল অবস্থায় না পড়লে ধরা পড়ার শঙ্কা নেই। আর ধরা পড়লে মধ্যবিত্ত- নিম্ন মধ্যবিত্ত হতাশাগ্রস্থ মানুষ সাময়িক বিনোদন পায় মাত্র।

তাদের নামের তালিকা দীর্ঘ। এক এক করে নাম উল্লেখ বা ছবি না দিলেও চলে। চোখের সামনেই ভেসে ওঠে ছবিগুলো।

মানুষের হাতে হাতে এখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের কতো মাধ্যম!আগামীকালের সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের ব্রেকিং স্ক্রলের অপেক্ষায় তর সইতে পারে না মানুষ। মূল ধারার গণমাধ্যমের জন্য অপেক্ষার দিন শেষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেলেনার কতো একান্ত যুগল ছবি ঘুরছে মন্ত্রী, এমপি, শাহেদ, সাবরিনাসহ বহু রথিজনের সঙ্গে। দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ভিকারুন্নেসার বালিশের নিচে পিস্তল রাখা প্রিন্সিপাল কামরুন্নাহার মুকুলের নানা কাহিনীও মানুষের তথ্য ক্ষুধায় বেশ খোরাক দিচ্ছে। সঙ্গে আগে তার এক সময়ের আগে-পরের স্বামী বেচারাদেরও কোয়ারেন্টিনের মতো লুকিয়ে থাকার অবস্থা। পিস্তলের ছিলছিলায় যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমন কি ভিসি পর্যন্ত হওয়া যায়, সেখানে কলেজ-স্কুলের প্রিন্সিপাল তো কমই। এর আগে মানুষ ক’দিন এ ধরনের ভিসি দেখেছে। এখন নয় তো প্রিন্সিপাল দেখলো। চাহিদা আর জোগানের তত্ত্ব চিন্তা করলে এসব ‘জিনিস’ গজানোর একটা জবাব মিলে।

বলতেই হয়- চাহিদা আছে বলেই এসব ‘মালের’ এতো আমদানি। নতুন নতুন দোকান। সরকারি গুদামের খাস মাল হিসেবে নিজেদের মার্কেটিংটা তারা বেশ সাফল্যের সঙ্গেই নিশ্চিত করেন। এরপর দাপট খাটানোর অভিযাত্রা। পদে-পদে সাফল্য। হেলেনা জাহাঙ্গীরের কর্মচারী লীগও অভিনব বা খুব বড় কিছু নয়। বিধবা লীগ থেকে শুরু করে নাপিত লীগ, দর্জি লীগ, হারবাল লীগ, ইলেকট্রিক লীগ, শিশু লীগ, বয়স্ক লীগ, তরকারি লীগ, অনলাইন লীগ কোনটা বাদ পড়ছে?

এসব দোকানের কর্মসূচিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে কিছু খরচপাতি করে হলেও অতিথি হন। বক্তৃতা দেন। মিডিয়া কাভারেজ পান। এসব দোকানে অতিথি হয়ে মিডিয়া কাভারেজে ধন্য হয়ে মন্ত্রীত্ব পাওয়া ‘মাননীয়’ সংখ্যাও কম নয়। গত যুগখানেক ধরে এ ধরনের সংগঠনের হোমড়া-চোমড়ারা ক্ষমতার কোন চর্চা না করছেন? কখনো কখনো বেটক্কা কিছু হয়ে গেলে ‘দোকান’টিকে অস্বীকার পর্ব। কিছু হুমকি-ধমকি। এর মাঝেই বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, কামাল, জামাল, রাসেল, প্রজন্ম, লীগযুক্ত আজব নানা নামের এসব সংগঠনের দেওয়াল লিখন, পোস্টার, ব্যানারে সয়লাব পাড়া-মহল্লা, রাস্তাঘাট, বাজার। ভরে আছে ফেসবুক। আছে ইউটিউবেও। এরা সেমিনার, গোলটেবিল, মানববন্ধনসহ কতো কিছু করে। বক্তা, অতিথির হেলে পড়ার অভাব হয় না।

হেলে বা না হেলে তৈরি করা এই নারীরা স্রেফ প্রমোদ তরী। ভ্রমণ শেষতো ঘাটে ডুবিয়ে দেয়া। এর আগ পর্যন্ত শিক্ষিকা, নায়িকা, গায়িকা এমন কি ডাক্তার, ব্যবসায়ীও। যে কারণে পিস্তল ওয়ালি শিক্ষিকাকে পুলিশ এখনো ধরে না। পিস্তলটাও জব্দ করে না। আবার ঘটনাচক্রে ধরা পড়ে গেলে সঙ্গে হরিণের চামড়া, মদসহ কতোকিছুই উদ্ধার ও জব্দ হয়। সেফুদার সঙ্গে যোগাযোগের হালকা রসঘন কিচ্ছাও প্রকাশ পাবে। আগে ধরা পড়াদের নিয়েও এমন সব তথ্য যোগান দেয়া হয়েছে। যা আসল অপরাধ থেকে দৃষ্টি ডাইভার্ট করার মোক্ষম কৌশল। আরো কেউ কি হেলে না, তা তখন মানুষ ভুলেই যায়। নানা মতলবে কোথায় হেলেন না ক্ষমতার মৌলোভীরা? তাদের দিকেই বা কে হেলেন না? ঘটনাচক্রে বাঁটে পড়ে গেলে আবার একে একে কেটে পড়ার কৌশল। যে যেভাবে পারেন সটকে পড়েন। প্রথম চোটে অস্বীকার, পরে বহিষ্কার। যতো দোষ তখন হেলেনা, মুকুল, পরিমণী, পাপিয়া, সাবরিনা, শাহেদ, সম্রাটদের। কিন্তু, নিশানায় পড়ে সরকার। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে এর দায় নিতে হয়। ক্ষমতায় আছে বলে অভিযোগের তিরটি বিঁধে সরকারের বুকে।

Array
We use all content from others website just for demo purpose. We suggest to remove all content after building your demo website. And Dont copy our content without our permission.