ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মতো বিএনপির নাম ব্যবহার করেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভুঁইফোঁড় সংগঠন। জাতীয়তাবাদী সমর্থিত এমন অর্র্ধশত সংগঠন রয়েছে।
যাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ। জাতীয়তাবাদী আদর্শের আদলে এসব সংগঠন প্রতিষ্ঠা হলেও এর পেছনের শক্তি ও বুদ্ধিদাতা হিসাবে কাজ করছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামী।
সুকৌশলে পর্দার আড়াল থেকে সবকিছুর জোগান দিচ্ছে দলটি। বলা যায়, জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বিএনপির নামে নামসর্বস্ব এসব সংগঠনকে দীর্ঘদিন ধরে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো যুগান্তরকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ২০০৯ সালের পর থেকেই এ ধরনের সংগঠনের উত্থান ঘটে।
সেই সময় আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোকবলও সরবরাহ করে দলটি। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর এসব সংগঠনের দৌরাত্ম্য কমতে শুরু করে। আর করোনা মহামারি শুরুর পর তাদের কোনো কর্মকাণ্ড এখন প্রকাশ্যে দেখা যায় না। তবে জামায়াত সমর্থিত সংগঠনগুলো পর্দার আড়ালে এখনো নানাভাবে সক্রিয়।
জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ নানা নামে গড়ে ওঠা এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের দৌরাত্ম্য কমলেও এ নিয়ে সতর্ক বিএনপি।
কয়েকটি সংগঠনের নাম উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই বলেও বিভিন্ন সময়ে জানানো হয়েছে। নেতাকর্মীদের ওইসব সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতেও বলা হয়। এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশ না নিতে নেতাদের বারবার মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু বিএনপির কিছু নেতা দলীয় কর্মসূচির চেয়ে এসব অনুষ্ঠানে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাই বারবার নির্দেশের পরও তাদের আটকানো সম্ভব হয়নি। ওইসব নেতার দাবি, বর্তমান সরকার মাঠের রাজনীতিকে সীমিত করে দিয়েছে। দলীয় কোনো কর্মসূচি পালনে নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
তাই এসব সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করা যায়। বলতে গেলে, এ ধরনের বিতর্কিত সংগঠনগুলোই এখন সরকারবিরোধী প্ল্যাটফরমে বিশেষ ভূমিকা রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১০ সালের মার্চে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই বছর জুলাইয়ে আটক করা হয় জামায়াতের শীর্ষ নেতা কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে।
সেই সময় জামায়াত যাতে প্রকাশ্যে বিচারকার্যের বিরোধিতা না করতে পারে, সেজন্য কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। রাজপথে জামায়াতকে কর্মসূচি পালন করতে বাধা দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী অবস্থান তৈরি করতে কৌশলের আশ্রয় নেয় দলটি।
বিএনপির সমর্থনে নানা সংগঠনের উত্থান ঘটায়। আগে যেসব ভুঁইফোড় সংগঠন নিষ্ক্রিয় ছিল, তাদের সক্রিয় করা হয়। ওই সময় জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রায় প্রতিদিনই এসব সংগঠনের ব্যানারে নানা কর্মসূচি পালন করা হতো।
এসব অনুষ্ঠানে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকতেন। শুধু তা-ই নয়, বিএনপিতে জামায়াতপন্থি হিসাবে পরিচিত নেতাদেরও অতিথি করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নানা বক্তব্য দিতেন জামায়াত নেতারা।
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এসব সংগঠনের তৎপরতা ছিল। কিন্তু ওই বছর জাতীয় নির্বাচনের পর জামায়াত এসব সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা থেকে কিছুটা পিছিয়ে আসে। ফলে আর্থিক সংকটে অনেক সংগঠনই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কথা না বলে ফোনের লাইন কেটে দেয়।
রোববার বিকাল ৩টা ৫৯ মিনিটে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারকে ফোন করা হলে তিনি তা রিসিভ করেন।
যুগান্তরের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে কথা বলা যাবে না। পরে ফোন করেন। এরপর তাকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দলে ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন রয়েছে। এর বাইরে দলের নাম ব্যবহার করে অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে এসব সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।
তাদের কর্মকাণ্ডে অনেক সময় দল ও সংগঠনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়। তাই নেতাকর্মীদের এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠন সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। সবাই সতর্ক থাকলে তারা সুবিধা করতে পারবে না।’
প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ। চাঁদাবাজির লক্ষ্যে তাদের একটি সিন্ডিকেটও রয়েছে। কোন সংগঠন কখন অনুষ্ঠান করবে এবং অতিথি কে থাকবেন, তা-ও নির্ধারণ করে ওই সিন্ডিকেট। কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলেই ব্যানারে চমকপ্রদ একটা শিরোনাম জুড়ে দিয়ে আয়োজন করা হয় আলোচনাসভা। এসব অনুষ্ঠানে বিএনপির মাঝারি সারির নেতা থেকে সিনিয়র নেতারাও অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকেন। আবার বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী, এমনকি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারাও থাকেন অতিথি তালিকায়।
এসব সংগঠনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বেশির ভাগই বিএনপি সমর্থিত বলে চিহ্নিত। চাঁদাবাজির পাশাপাশি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে তারা একটা সখ্য গড়ে তোলেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের কয়েকজন বিএনপিতে পদও বাগিয়ে নেন। এমনকি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনেকে পদ বাণিজ্যও করেন। ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলোর মধ্যে ৩৮টি সংগঠন মিলে ‘বিএনপির সহযোগী সংগঠন ঐক্য পরিষদ’ গঠন করেছিল ২০১৪ সালের আগস্টে। সেই সময় তারা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। কিন্তু বিএনপি তাদের অনুমোদন দেয়নি। সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা বিভিন্নভাবে নিজেদেরকে সামনে আনার চেষ্টা করেছে; কিন্তু সেভাবে সুবিধা করতে পারেনি।
এদিকে বিএনপি বা দলের শীর্ষ নেতাদের নাম ব্যবহার করে কোনো সংগঠন করা যাবে না বলে বারবার সতর্ক করে দলটি। কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতেও বলা হয়। এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকায় দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে নেতাকর্মীদের অনুরোধ জানান। ২০১২ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তত ৪০টি সংগঠনের নাম উল্লেখ করে সেগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে নেতাকর্মীদের আহ্বান জানানো হয়। এমনকি ‘জাতীয়তাবাদী তরুণ দল’ নামে একটি সংগঠনের ব্যাপারে সতর্ক করতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। একইভাবে ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল জিয়া-খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে তোলার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় বিএনপি। ওই সময় ‘তারেক জিয়া সেবা ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি ‘শহীদ জিয়া ছাত্র পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন নিয়ে বিব্রত অবস্থায় পড়ে দলটি। ছাত্রদল তাদের ব্যাপারে হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ করে। এরপর সোমবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, ওই সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বিজ্ঞপ্তিতে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, ‘শহীদ জিয়া ছাত্র পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানানো যাচ্ছে, সংগঠনটির সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক বা সংশ্লিষ্টতা নেই। সংগঠনটি বিএনপির অধিভুক্ত কোনো সংগঠন নয়। বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তবে কিছু সংগঠনকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে বিএনপি। বিশেষ করে ড্যাব, এ্যাবসহ কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠন দলের অঙ্গসংগঠনের মর্যাদা না পেলেও দলীয় সমর্থন পেয়ে আসছে। দলের যে কোনো কর্মকাণ্ডে এসব পেশাজীবীর উপস্থিতিও লক্ষ করা যায়। এমনকি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময়ে এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবেও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিএনপির থিঙ্কট্যাংক হিসাবে ‘জি- নাইন’ (গ্রুপ-২০০৯) ও ‘শত নাগরিক কমিটি’কে সমর্থন দিয়ে আসছে দলটির হাইকমান্ড।
বিএনপির নাম ব্যবহার করে ভুঁইফোঁড় যেসব সংগঠন গড়ে উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক একাডেমি, সম্মিলিত সমন্বয় পরিষদ, জিয়া নাগরিক ফোরাম, জিয়া আদর্শ একাডেমি, তৃণমূল দল, জিয়া সেনা, স্বদেশ জাগরণ পরিষদ, দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পরিষদ, জিয়া স্মৃতি সংসদ, চেতনায় ৭১, সচেতন নাগরিক ফোরাম, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, নাগরিক অধিকার সোসাইটি, গণতান্ত্রিক ঐক্য ফোরাম, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জোট, জাগ্রত জনতা ফোরাম, নাগরিক পরিষদ, হৃদয়ে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম, জিয়া নাগরিক সংসদ, স্বদেশ মঞ্চ, জিয়া ব্রিগেড, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সেবা দল, জাতীয়তাবাদী বন্ধু দল, সমবায় দল, জাতীয়তাবাদী দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন, জিয়া ন্যাশনালিস্ট ফোরাম, বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরাম, জাতীয়তাবাদী বাউল দল, জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী কল্যাণ পরিষদ, খালেদা জিয়া মুক্তি পরিষদ, তারেক রহমান মুক্তি পরিষদ, তারেক রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদ, শহীদ জিয়াউর রহমান আদর্শ বাস্তবায়ন পরিষদ, জাতীয়তাবাদী কৃষি আন্দোলন প্রমুখ।
Array